দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে। বেশ কিছুদিন ধরেই বড় ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা। ডলারের উচ্চ মূল্য, ক্রমাগত বাড়তে থাকা সুদহার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে কমছে পণ্যের চাহিদা।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি শিল্পে প্রতিযোগিতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে এ খাত। অথচ বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বরাবরই মূলধারার বাইরে।
এ কারণে নানামুখী সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থের অপ্রাপ্তি, প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষতার অভাব, বিনিয়োগে ঘাটতি, রপ্তানি বাজারে অনুপ্রবেশের অক্ষমতা, নীতিসহায়তার অভাব ইত্যাদি।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয় ও সঞ্চয় সীমিত। আবার ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কম। অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, অবকাঠামোগত ঘাটতি, বাজারে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সুরক্ষা এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা চেয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি: বাংলাদেশের শিল্পনীতি-২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। এমএসএমই খাত পণ্য ও পরিষেবার ৩৩টি উপখাতে বিভক্ত।
২০১৯ সালের শিল্পখাতের জরিপ অনুযায়ী দেশে গৃহকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৩ শতাংশই অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই জরিপ অনুযায়ী অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ৯০ শতাংশ ব্যবসা এবং ৫০ শতাংশের অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা দেশের ৮৭ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
সরকার এ খাতের সুরক্ষায় এসএমই পলিসি ২০১৯ গ্রহণ করে, যার মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হয়েছে। কিন্তু অনেক লক্ষ্যই পূরণ হয়নি।
সমাধানের উপায়: বাংলাদেশে এসএমই খাতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ অর্থপ্রাপ্তি। আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের আকার প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে এসএমই খাতের জন্য দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যথাযথ কাগজের অভাবে অর্থপ্রাপ্তিতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসার ধারাবাহিক তথ্য না থাকায় এর অর্থনৈতিক বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, উৎপাদন সূচকের ক্রমাগত পতন সরাসরি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের আঘাত করছে। মূল্যস্ফীতি এবং অন্য সামষ্টিক অর্থনীতিক সূচকে পরিবর্তন আনতে সময় লাগলেও, এ খাতে ঋণ প্রবাহের দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রি-ফান্ডিং, পোস্ট ফান্ডিং এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের সম্প্রসারণ কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে কিছুটা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা আশাকরি সুদের হার দ্রুতই কমানো হবে।
নতুন মুদ্রানীতির কারণে খাতটি সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেটের সীমাবদ্ধতা এ খাতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। নতুন মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় কাজের মূলধনের অভাব দেখা দিয়েছে। এসএমই বাড়ানো ছাড়া অর্থনীতির বিকাশ হবে না।
সমন্বয় জরুরি: এসএমই ফাউন্ডেশন পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, সরকারি ১৭টি বিভাগ সরাসরি এসএমই খাতে সংযুক্ত। তারা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন প্রজেক্ট নেয়, যা পাঁচ থেকে সাত বছর আগের পরিকল্পনা করা। সমন্বয়হীনতা ও আগের ধারণা থেকে প্রজেক্ট নেওয়ার কারণে অনেক সময় সরকারি অর্থ অপচয় হয়।এসএমই নীতিমালার উন্নতির জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, এসএমই নীতি পর্যালোচনার সুপারিশ রয়েছে। বর্তমান নীতিমালায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে বলে আগের লক্ষ্যগুলো পর্যালোচনা করা হবে।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর মোট জিডিপির ৬০-৭০ শতাংশ এসএমই অবদান রাখে। ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের তিন ট্রিলিয়ন ডলার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা প্রয়োজন। এজন্য আলাদা এসএমই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
রাশেদুল করিম এসএমইকে সহায়তার জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য পণ্যভিত্তিক পেশাদার প্রশিক্ষণের দিকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, পণ্য ডিজাইন, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিকে সুসংহত ও সমন্বিত পদ্ধতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
ব্যবসা সম্প্রসারণ: নতুন ব্যবসা শুরু করতে উদ্যোক্তারা নানাবিধ সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পুঁজি সংস্থাপন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ, কাঁচামাল প্রাপ্তি, বিপণন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েন।
জুটেক্সের (একটি পাটভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোগ) মালিক আকতারুজ্জামান তুষার বলেন, আমি সব সময় পাটখাতে কিছু করার চিন্তা করতাম। কিন্তু আমি দক্ষ জনশক্তি খুঁজে পাওয়া এবং ঋণ সুবিধা পাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি।