এসএম শামীম : সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবির মুখে- গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে, সফল হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। যদিও হাসিনা সরকার পদত্যাগের তিন দিনের মধ্যেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যাদের প্রধান লক্ষ্য- বৈষম্য দূরীকরণ। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ইউনুস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই আমূল পরিবর্তন আসে বেশ কয়েকটি দপ্তরে। এরমধ্যে- আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ অন্যতম।
সম্প্রতি দেশের বহু গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী একটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হল- স্থানীয় সরকারে বৈষম্য। যার শিকার হয়েছেন- দেশের সকল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানগণ। তাদের বক্তব্য- আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমাদের সাথে অন্যায় হয়েছে, অবিচার হয়েছে। আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের বিপুল পরিমাণ ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই আমাদের কেন অপসারণ করা হলো?
স্থানীয় সরকার। কোন নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায়, যা কেন্দ্রীয় সরকারেরই একটি সমপ্রসারিত অংশ। যেমন- সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে- ওপর থেকে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যকে একটি সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে নিম্নতর পর্যায়ে হস্তান্তর করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রতিটি স্তর একে অপরের সাথে জড়িত থাকে এবং এদের সকলের কাজের মধ্যে থাকে সমন্বয়।
গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। ফলে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গঠন করা হয় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। যার দ্বারা তৃণমূল পর্যায়ের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে। এছাড়াও স্থানীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানগণ। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা ও স্থানীয় সরকার সচিব বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ গণমাধ্যমের সামনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তারা।
লিখিত বক্তব্যে ভাইস চেয়ারম্যানরা বলেন, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলতি বছরের মে ও জুন মাসে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। যেখানে আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করি। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন আমাদের যাচাই-বাছাই করে বৈধপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতীক পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। নির্বাচনে আপামর জনসাধারণের ভোটের মাধ্যমে আমরা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হই।
লিখিত বক্তব্যে তারা আরও বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবির মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ফলে, সফল হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। যদিও এই সফলতায় ঝড়েছে বহু প্রাণ। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। আমরা এই আন্দোলনে বীর শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি আহতদের সুস্থতা কামনা করি।
তারা আরও বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর ১২ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের উপস্থিতির তথ্য চাওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১২ এবং ১৩ আগস্ট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের উপস্থিতির তালিকাও পাঠানো হয়। যেখানে দেশের প্রায় সকল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানগণ নিয়মিত অফিসে উপস্থিত ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়। পরে ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অপর আদেশে জানানো হয়- যে সমস্ত উপজেলায় চেয়ারম্যান বা প্যানেল চেয়ারম্যানগণ অনুপস্থিত সেখানে- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তীতে ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকারের অধীনে সকল জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের ক্ষমতা নেয় সরকার। এর পর প্রথমে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়।
তাদের দাবি, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও ভাইস চেয়ারম্যানগণ নিয়মিত অফিস করেছেন। কারণ- ভাইস চেয়ারম্যানগণ বিভিন্ন দল ও ভিন্ন মতাদর্শের। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। বিশেষ করে নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা অনেকেই গৃহিণী। তাদের দলীয় কোন পরিচয় নেই। তারা কোন দলের সভা-সমাবেশেও অংশগ্রহণ করেননি। তারপরেও কোন প্রকার কারণ দর্শানো ছাড়াই কেন তাদের অপসারণ করা হলো?
শুধু তাই নয়, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কাউন্সিলরগণ, জেলা পরিষদের সদস্যগণ এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ স্ব পদে বহাল আছেন। সেখানে আমরা কেন স্ব পদে বহাল থাকতে পারিনা?
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তো আমাদের ভাই-বোন ও আমাদের সন্তানেরাও ছিল। যেখানে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলন করে নতুন স্বাধীনতা এসেছে- সেখানে আমরা কেন বৈষম্যের শিকার?
অপসারিতরা বলেন, জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা নির্বাচিত হয়েছি মাত্র দেড় থেকে দুই মাস। নির্বাচন করতে গিয়ে আমাদের- আর্থিক, শারীরিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা মানসিক ও সামাজিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত। আর তাই- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা জনাব হাসান আরিফের সুদৃষ্টি কামনা এবং ন্যায়বিচার দাবি করছি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক, গবেষক ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সাক্ষাৎকারে কয়েকটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, স্থানীয় সরকারের মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। যে সমস্ত সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে তাদেরকে দিয়ে খুব বেশিদিন নাগরিক সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
এছাড়াও সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দিকে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করেছিল ইতোমধ্যে তারা পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি বিদায়ী ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাদের কমিশনের দায়িত্বে যে কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে- তার মধ্যে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে।
এদিকে উল্লেখিত বিষয়টি পর্যালোচনা করলে- বৈষম্যের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া দলীয় প্রতীকবিহীন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদি অপসারণ করতেই হয়, তবে- ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যাদের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যারা এই উপজেলা নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিসার পর্যন্ত সকলকে অপসারণ করা উচিত হবে বলে মনে করি। অন্যথায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই বিজয় বৈষম্যের কষাঘাতেই জর্জরিত হতে থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল- s.m.s.journalist.bd@gmail.com